কফি হাউজ
লেখা ও ছবি : নাদিম আহমেদ
” সেই সাত জন নেই আজ টেবিলটা তবু আছেসাতটা পেয়ালা অজোও খালি নেইএকই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়িশুধু সেই সেদিনের মালী নেইকত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউসেকত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়কত জন এল গেলো কতজনই আসবেকফি হাউসটা শুধু থেকে যায়। “
মান্না দে। যার গলায় এ গানটি যেন পেয়েছে অমরত্ব। কখনো যেন হারাবে না এ গানটি মানুষের মুখ থেকে। ছোট বড় যারাই এ গানটি একবার শুনেছেন, তারাই যেন মনের অজান্তেই নিজের মধ্যে ধারন করেছেন এ অসাধারন গানের এক একটি চরিত্র। তৈরি হয়েছে সিনেমা ও নাটক।
আমি মালয়শিয়া থেকে বাংলাদেশে ফেরার আগে কলকাতা হয়ে দেশে ফিরি। আগে থেকেই মাথার ভিতর ছিল যে, এবার সেই কফি হাউজ টা দেখতে যাব। যে হাউজটার জন্য সৃষ্ঠি হয়েছে এক অসাধারন গান।
জানা যায়, আলবার্ট হল থেকেই কফি হাউজ। মাঝে ১৪০ বছর চলে গেছে ! পরিবর্তন এসেছে ভৌগলিক সীমা রেখাতে। আন্দোলন-সংগ্রামে পাল্টে গেছে অনেক ইতিহাস। এই দীর্ঘ এ যাত্রা পথেও কফি হাউজের আড্ডায় মলিনতা আসেনি বুঝি এতোটুকুও। চাকচিক্য নেই আগের মতো। নেই সেই আগের চরিত্রগুলো। গানটির বয়সের হিসেবে থাকার কথাও নয়। কিন্তু বাঙ্গালিদের আড্ডার যে রূপ তা আজও ধরে রেখেছে এই কফি হাউজ। একটি টেক্সিতে উঠে ড্রাইভার কে বলতেই সে আমায় নিয়ে রওয়ানা হলো সেই কফি হাউজের উদ্দেশ্যে।
মির্জা গালিব স্ট্রীট হতে প্রায় ২০ মিনিট এর যাত্রা। গন্তব্য আমার কলেজ স্ট্রিটের সেই বিখ্যাত কফি হাউজ। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে গাড়ি থেকে নামতেই চোখে পড়লো ড্রাইভারের বলে দেয়া সাইন র্বোড ইন্ডিয়ান কফি হাউজ নামের বিল্ডিং টা। বেশ প্রাচীন তিনতলা ঘর। ব্রিটিশ ভারত বর্ষে এ অঞ্চলের রাজনীতি-শিা-সাহিত্য ও সাংবাদিকতার আন্দোলনের সূতিকাগার কলকাতার এ কফি হাউজ।
বিশেষ বিশেষ স্মৃতি বহন করা এ ঘরের সিড়ি ভেঙ্গে দু’তালায় উঠতে উঠতে চোখে পড়লো নানা রকমের ছবি, স্মারক, লিফলেট আর লেখিয়ে বন্ধুদের আড্ডার কতো কথা দেয়ালে দেয়ালে। সবই যেন রুপ নিয়েছে এক ক্যানভাসে। আর আমার মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকলো সেই গানের অসাধারন কথাগুলো।
আর পাচঁ-সাতটা বাঙালি রেস্টুরেন্টের মতোই কলকাতার কলেজ স্ট্রীটের এ কফি হাউজ। দম ফেলবার ফুরসৎ নেই যেন শেরওয়ানী ও পাগড়িধারী বেয়ারাদের। কিন্তু কফি হাউজের সেই কফি না খেলেতো নয়! একটু পরেই একজন শেরওয়ানী ও পাগড়িধারী বেয়ারা আমার কাছে এসে জানতে চাইলেন আমি কি খাব ? আমি একটি কফির অর্ডার করলাম, গরম কফির পেয়ালায় একটু একটু করে চুমুক দিয়ে দেখতে থাকলাম কফি হাউজ এর আস পাশ। শত শত মানুষের যাওয়া-আসা চলছে।
কিন্তু তার মাঝেও এ কফি হাউজের রয়েছে বৈচিত্র্য ভরা ঐতিহ্য।
জানা যায় ১৮৭৮ সালের এপ্রিল মাসে তৎকালীন ব্রিটিশ রানী ভিক্টোরিয়ার স্বামী আলবার্টের নামকরণে এটির নাম করণ করা হয় আলবার্ট হল। তাছাড়া মুল ফটকের প্রবেশ মুখে খোদাই করে লেখা রয়েছে ১৮৭৬ খৃস্টাব্দের ২৬ জুলাই এই আলবাট হল সভাগৃহে ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন এর ভারত সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের দিকপাল কবি, সাহিত্যিক, উপন্যাসিক এবং সাংবাদিকদের আড্ডা ছিলো এ হলে। এর কাছেই রয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং কলকাতা মেডিকেল কলেজ।
আর এ কারণে শিার্থীদের ভিড় বেশি এখানে চোখে পড়ার মতো। প্রয়াত মান্না দে’র সে বিখ্যাত সে গান কফি হাউজের চরিত্রগুলো এখন আর না থাকলেও নতুন নতুন চরিত্রের কিন্তু কোনো কমতি নেই এখানে। প্রতি নিয়তই যেন এখানে সৃষ্ঠি হয়ে চলেছে এক একটি চরিত্র। বতর্মানে টি কো-অপারেটিভ এসোসিয়েশনের ব্যবস্থাপনায় চলছে এ কফি হাউজ। জানা যায় কফিহাউজ গানটি নিয়ে মান্না দে সবসময় নিজের চেয়েও বেশি কৃতিত্ব দিতেন গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার ও এর সুরকারকে। তিনি শুধু গানটা গেয়েছিলেন মাত্র। তবে মান্না দের কণ্ঠে যে গানটি চিরকালীন পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে সেকথা স্বীকার করে নিতেই হয়। গানটির সুরকার ছিলেন সুপর্ণকান্তি।
আমার এক ঘন্টার এ কফি হাউজ বিরতি শেষে সিড়ি ভেঙ্গে নিচে নামতে নামতে
ভাবলাম কফি হাউজ গানের সেই সাত জন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে, সাতটা পেয়ালা অজোও খালি নেই।
গরম কফির চুমুকে চুমুকে চলছে নবীন-প্রবীনদের আড্ডা। এক মুহুর্তের জন্যেও যেন নিরব নয় এ বিশাল হল রুমটা। কতো কথা, কতো আনন্দ বেদনার স্বপ্ন নিয়ে আসা যাওয়া চলে দিন রাত এ কফি হাউজে।
আর তাইতো গানের শেষ লাইনটা ছিল ঠিক এমনই কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউসে কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়, কত জন এল গেলো কতজনই আসবে কফি হাউসটা শুধু থেকে যায়।